বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার পর কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের পর বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের শেষে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে এবারের ঘটনাই ছিল সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের, যা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে চিন্তায় ফেলেছিল বলে মনে করেন তারা।
চলতি মাসের শুরু থেকে ছাত্র বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও ১৬ জুলাই ছয়জনের মৃত্যুর পর ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিবর্ষণ, শতাধিক মৃত্যু, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন এবং ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা সারাবিশ্বে তোলপাড় তৈরি করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে বলে সরকার থেকে বলা হলেও প্রশ্ন উঠছে যে এবারের ঘটনাই আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের শাসনকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা সরকারকে উদ্বেগে ফেলেছিল কী-না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘটনার ভয়াবহতা ও রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া থেকে এটা অনুমেয় যে ‘এবারই প্রথম সরকারের মধ্যে উদ্বেগ তৈরির’ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন তারা।
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, সরকার উদ্বিগ্ন হয়েছে ‘দেশ আক্রান্ত হয়েছে বলে’। তবে এখানে ভয় পাওয়ার বা চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই।
এবারের ছাত্রবিক্ষোভই কি সরকারকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে?
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার মুখোমুখি হয়েছিল দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি – বিডিআর বিদ্রোহের।
এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২০১৪ ও ২০২৪ সালের বিরোধী দলহীন নির্বাচন, হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে অবস্থান, ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সবশেষ চলতি মাসের দ্বিতীয় দফার কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলোতে সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
তবে আগের ঘটনাগুলোতে প্রাণহানির সংখ্যা ও সহিংসতার মাত্রা এবারের চেয়ে অনেক কম ছিল এবং সেগুলো মোকাবেলায় সরকারকে এবারের মতো ‘চিন্তিত’ মনে হয়নি বলে বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
এবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি ‘স্বৈরাচার’ আখ্যা দিয়ে স্লোগান দেয়া হয়েছে বেশকিছু মিছিলে, যা আগে শুধু বিএনপি নেতাদের কণ্ঠেই শোনা যেতো।
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, এসব স্লোগান বিএনপি-জামায়াত আগে থেকেই দিয়ে আসছে, যা তার মতে ‘বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করেনি’।
‘এগুলোর কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই’ বলে মনে করেন তিনি।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শারমীন আহমেদ বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে চলমান কোটা আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়া দিয়ে গেছে।
‘২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন সরকারকে সরাসরি ছাত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। তবে অন্য অনেক ফ্যাক্টর আর হতাহতের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে এবারের ঘটনাই সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে সরকারের সামনে আবির্ভূত হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
আরেক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক থাকলেও এবারের ঘটনাপ্রবাহ ছিল জনগণকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতায় থাকার যে চিন্তা, তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া।
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও সরকারকে মনে হচ্ছিল তারা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের এতদিনকার সুসংহত যে অবস্থান সেটিকেও কিছুটা নড়বড়েই মনে হচ্ছিলো তখন,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত আলোচিত আন্দোলনগুলো সম্পর্কে একনজর দেখে নেয়া যাক।
বিডিআর বিদ্রোহ
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছিল।
সে ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্তকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। হত্যা করা হয়েছিল তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকেও।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সেনাবাহিনী ও আনসার বাহিনীতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলেও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নৃশংসতা বেশি ছিল বলে মনে করা হয়।
এ ঘটনার ২১ মাস পর বিডিআর নাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
ওই ঘটনার চার বছর পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে নিম্ন আদালত হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করে।
এই হত্যা মামলার মোট আসামির সংখ্যা ছিল ৮৫০ জন। নিম্ন আদালতের রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এছাড়া ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট।
আটজনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয় এবং পাঁচজন খালাস পান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এত বেশি সংখ্যক আসামির সাজা হাইকোর্টে অনুমোদন হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার
২০১০ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা চাপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার।
এক পর্যায়ে ২০১২ সালের শেষ দিক থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের পর সহিংসতা আরো বেড়ে যায়।
এর আগে প্রথমে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়েও দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
ওই আন্দোলন চলাকালেই ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডসহ নানা ঘটনায় দেশের পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
এরপর বিভিন্ন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কয়েকজন জামায়াত নেতার ফাঁসি কার্যকরের সময়েও দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
হেফাজত ও শাপলা চত্বর
২০১৩ সালের এপ্রিলে শাহবাগে যখন গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি চলছিল তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবি তুলে সংগঠনটি লংমার্চ ও ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ এবং শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকারম মসজিদের চারপাশের রাস্তা ও মতিঝিল এলাকা।
বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালিয়েছিল।
পরে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ঘিরে ধরে অভিযান চালিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দেয়।
এ সময় ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড আর শত শত রাউন্ড গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা।
২০১৪ সালের নির্বাচন
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল। বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিলো।
এর জের ধরে নির্বাচনের আগে ও পরে প্রায় তিন মাস ধরে সংঘাত সহিংসতা হয়েছিল বাংলাদেশে।
ঢাকায় অসংখ্য বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
যদিও নির্বাচনের আগে ৩৮টি জেলায় প্রায় দেড় শ’র মতো কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট পেপার ও নির্বাচন সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিসংতায় ভোটের দিন অন্তত ১৮ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাসে আগুন ও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে দুই শ’র বেশি মামলা হয়েছিল।
সরকারের অভিযোগ, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার বিচার ও ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীরা ওই সময় ‘যানবাহন ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপনায় আগুন দিয়েছিল’।
তবে বিএনপি বরাবরই সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এসব ঘটনার জন্য উল্টো সরকারকেই দায়ী করে আসছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ জুড়ে চলছিল স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের জের ধরে প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে ওই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
ছাত্রবিক্ষোভ সামাল দিতে বিক্ষোভের তিন দিনের মাথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর আন্দোলন আরো ছড়িয়ে পড়েছিল।
উল্টো আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনা ও চাপে পড়ে সরকার।
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন আরো জোরদার করলে সংসদে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস করে সরকার।
যদিও পরে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবির মুখে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৮ এবং নির্বাচন
কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালের শুরু থেকেই আন্দোলন করছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
তখন পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন হয় যার মূলকথা ছিল কোটায় নিয়োগ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা।
ওই বছর ফেব্রুয়ারিতেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
সে বছরের ৮ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা বিশাল মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। সেদিনই ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
পরের কয়েকদিনের নজিরবিহীন আন্দোলনে সারাদেশেই শিক্ষার্থীরা জড়িত হয়ে পড়ে।
এরপর ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী সংসদে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন।
তবে তারপরেও কয়েক সপ্তাহ ধরে নানা ঘটনা ঘটে, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কয়েক দফা হামলার ঘটনা ঘটে ও শিক্ষার্থীরাও পাল্টা কর্মসূচি দেয়।
পরে এই কোটা আন্দোলনের একজন নেতা নুরুল হক নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন।
একই বছরের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও চাপের মুখে পড়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে পরে তা ধরে রাখতে পারেনি বিরোধী দলগুলো।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও ছিল বিরোধী দলহীন। এ নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল।
তার আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সরকারকে ব্যাপক চাপে ফেলেছিল।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোও ব্যাপক আন্দোলনের চেষ্টা করে। কিন্তু নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতাদের আটক করা হয়।
কিন্তু এ অবস্থাতেও একতরফা নির্বাচন করেই ক্ষমতা ধরে রাখে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনের ছয় মাস পরে এসে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হলো সরকারকে হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে।
২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র সরকার জারি করেছিল, একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে জুন মাসের শুরুতে সেটি বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।
এরপরই নতুন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়, রক্তাক্ত সহিংসতার মাধ্যমে যার আপাত সমাপ্তি হয়েছে ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ‘আমরা ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হয়েছিলাম। ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। তবে দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে আমরা যথাসময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
‘এবার যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা গত ৫৩ বছরে ঘটেনি। রাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতই এটি করেছে।’
‘এতে আমরা উদ্বিগ্ন হয়েছি, তবে বিচলিত হইনি। আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা আরো যা বলছেন
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেছেন, চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সাথে যে জনগণের অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবার।
‘সরকারকে হতবিহ্বল এবং রাজনৈতিক মোকাবেলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত মনে হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্র্যাকটিস হয়ে গেছিল যে ছাত্রলীগ এগুলো মোকাবেলা করবে। এবার কৌশলটা বুমেরাং হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
‘এ কারণে ছাত্রদের তোপের মুখে ছাত্রলীগকে পালাতে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার উপায় খোঁজার চেষ্টাটা ছিল দৃশ্যমান,’ বলেন অধ্যাপক নাসরীন।
আর শারমীন আহমেদ বলেন, এবারের ঘটনায় তার মনে হয় টিকতে হলে সরকার ও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ পরিবর্তন আনতে হবে।
‘এবারের ঘটনা আগেরগুলোর চেয়ে সার্বিক বিচারে সরকারের জন্য অনেক বেশি আঘাত ছিল।’
‘অনেকগুলো ফ্যাক্টর এবার একসাথে কাজ করেছে, যেগুলো নিয়ে করণীয় নির্ধারণে সরকারকে কিছুটা হলেও হিমশিম খেতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছিলো,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
তবে, বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ বা হামলা এলে ধৈর্য্যসহকারে সরকারকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হয়, এবারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
‘সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং সেজন্য যা করণীয় তাই করেছে সরকার। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে কখনোই হামলাকারীরা টিকতে পারে না, পারবেও না,’ বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি